লক্ষ্মীপুরের মানুষের কাছে গত ৪ আগস্ট রাত ছিল অন্য রকম। ওই দিন সন্ধ্যার পর শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে—এ কে এম সালাহ উদ্দিন ওরফে টিপু পালিয়েছেন। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি। প্রশাসন আর থানা-পুলিশ যাঁর কথায় নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি পালাবেন! এরপর প্রায় দুই মাস কেটে গেছে। আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সদর উপজেলা পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিনকে।
একসময়ের ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর এখন অনেকটা শান্ত। এত দিন চুপ থাকা মানুষগুলো জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাহ উদ্দিনের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, সালাহ উদ্দিনের উত্থান ‘তাহের–পুত্র’ হিসেবে। তাঁর ও তাঁর পরিবারের ইশারায় আবর্তিত হয়েছে লক্ষ্মীপুরের রাজনীতি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা বিপুল সম্পদেরও মালিক হয়েছেন
সালাহ উদ্দিন ও তাঁর পরিবার দলের ত্যাগী নেতা ও সাধারণ মানুষকে এত দিন জিম্মি করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের যে এত ক্ষমতা, তার মূলে ছিলেন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র প্রয়াত আবু তাহের। তাহের মারা
যাওয়ার পর তাঁরা ঘিরে ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) নুর উদ্দিন চৌধুরীকে। তিনি (নুর উদ্দিন) সালাহ উদ্দিনের মামাতো বোনের স্বামী।
তাঁরা বলছেন, সালাহ উদ্দিনের উত্থান ‘তাহের–পুত্র’ হিসেবে। তাঁর ও তাঁর পরিবারের ইশারায় আবর্তিত হয়েছে লক্ষ্মীপুরের রাজনীতি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা বিপুল সম্পদেরও মালিক হয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী ক্ষমতায় আসার পর আবু তাহের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় সারা দেশে আলোচনায় আসেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর তাহের, তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে খুনসহ বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁরা পলাতক ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর তাহের পরিবার লক্ষ্মীপুরে ফিরে আসে। তাহের আওয়ামী লীগের সমর্থনে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন বলে দাবি করেছেন এ কে এম সালাহ উদ্দিন। গত শনিবার মেসেঞ্জারে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রদের ওপর আমি গুলি করিনি। গুলি করেছি ওপরের দিকে। আত্মরক্ষার্থে ও পরিবার–পরিজনকে হেফাজতের জন্য গুলি করেছি। রাজনৈতিকভাবে আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছি, এ কারণে দলের ভেতরের ও বাইরের লোকজন অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কোনো অপকর্মে জড়িত ছিলাম না।’
গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। এমন সাজে বাড়ির ছাদে অবস্থান নিয়ে গুলি ছুড়ছেন সালাহ উদ্দিন। মাঝেমধ্যে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন নেতা-কর্মীদের। হাসছেন, আবার গুলি ছুড়ছেন। একই ছাদে তাঁর সঙ্গে আরও ২০–২৫ জনের অবস্থান। তাঁদের অনেকের হাতে অস্ত্র।
৪ ঘণ্টা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ
গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। এমন সাজে বাড়ির ছাদে অবস্থান নিয়ে গুলি ছুড়ছেন সালাহ উদ্দিন। মাঝেমধ্যে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন নেতা-কর্মীদের। হাসছেন, আবার গুলি ছুড়ছেন। একই ছাদে তাঁর সঙ্গে আরও ২০–২৫ জনের অবস্থান। তাঁদের অনেকের হাতে অস্ত্র। ছাদেই ড্রামের মধ্যে বানানো হচ্ছে শরবত, পান করে আবার গুলি করেন তাঁরা। লক্ষ্মীপুর শহরের সালাহ উদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি পিংকি প্লাজা থেকে গত ৪ আগস্ট এভাবেই টানা ৪ ঘণ্টা আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতার ওপর গুলি করা হয়। এর আগে আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে বাড়ির ছাদে অবস্থান নেন সালাহ উদ্দিন। এরপর বেলা ১১টা থেকে কিছুক্ষণ পরপর সড়কে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের লক্ষ করে গুলি করেন সালাহ উদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে ওই দিন সংঘর্ষে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা সালাহ উদ্দিনের চারতলা বাসভবন ও পাঁচতলা আরেকটি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সারা দিনে নিহত হন চার শিক্ষার্থীসহ ১২ জন। যার মধ্যে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও ছিলেন। ওই ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ও সাব্বির হোসেন হত্যা মামলায় সালাহ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
ওই দিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ মো. রবিন ও হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সালাহ উদ্দিনের অনবরত গুলির কারণে সেদিন হাসপাতালে এক ভয়াবহ চিত্র ছিল। সারি সারি গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী। শত শত মানুষের জটলা, চিৎকার। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও কোমরে, কারও পিঠে গুলির চিহ্ন। পুরো হাসপাতালের কোথাও ঠায় ছিল না।
ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা সালাহ উদ্দিনের চারতলা বাসভবন ও পাঁচতলা আরেকটি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সারা দিনে নিহত হন চার শিক্ষার্থীসহ ১২ জন। যার মধ্যে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও ছিলেন। ওই ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ও সাব্বির হোসেন হত্যা মামলায় সালাহ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের জে এম শাখার তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ব্যক্তিমালিকানা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে ৩৫টি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হলে জেলার বিভিন্ন থানায় ৩৪টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়ে। শুধু এ কে এম সালাহ উদ্দিনের নামে থাকা অস্ত্রটি জমা পড়েনি।
নিহত শিক্ষার্থী সাদ আল আফনানের মামা ষাটোর্ধ্ব হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন বাহিনী গুলি করে আমার একমাত্র ভাগিনাটাকে মেরে ফেলেছে। জোয়ান ছেলেডারে এইভাবে কবর দিতে হবে, জীবনে ভাবতেও পারিনি।’
লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে সেই দিন। গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তদন্ত হচ্ছে।